ঘড়ির তালে তাল মেলানোর মতো সময় নেই আজকাল আর। বোধহয় সকলের জীবনে এমন একটা করে সময় আসে, যখন সময় রিস্ট ওয়াচের কাছে ছুটি নিয়ে এসে হাতের তালুতে বিশ্রাম নেয়। যে কদিন সময়ের ছুটি থাকে, সে কদিন উড়ে বেড়ানো যায় অনায়াসে। তারপর সময়ের ঘুম ভেঙে গেলে দড়ি বাঁধা পুতুলের মতো নিস্তব্ধ বাধ্যতায় তার দাসত্ব করে চলতে হয়৷ কেউ থেমে থাকেনা, আবার কেউ ভুলেও যায়না। তবু এমন কৃষ্ণচূড়া ফোটা রক্তিম দিনগুলোতে বেশ অভিমান হয় প্রিয় ফুল ছোঁয়া হয় নি বলে। রাত্রিবেলা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনে জোনাকিপোকা দেখবার তেষ্টা পায়। কিন্তু কংক্রিটের ব্যালকনিতে বসে জোনাকিদের দেখা পাওয়া যায় না। সেখানে বড়জোর অন্ধকারে প্লেলিস্টে অঞ্জনসুর বাজতে থাকে একের পর এক। চোখ বুজে মত্ত হতেই মনে হয়, প্রেমিক অঞ্জন দত্ত বুঝি আমাকেই বললো "আমি জানি তুমি কোথায় যাও রোজ রাত্তিরে মনের ভেতর ঘুমের ঘোরে"। অথচ অঞ্জন কি জানে ঘুমের ঘোর ছাড়াও আমার আরো কিছু ঘোর যে কখনোই কাটবার নয়?
এবারের বৈশাখীপূর্ণিমায় মধ্যরাতে আকাশে তাকালেই দেখতে পাওয়া যেতো চাঁদটা ইশারায় ডাকে আর মেঘের সাথে খেলে বেড়ায়। ভোর হবার আগে মসজিদ থেকে "আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম" ভেসে আসার পর পরই রাস্তায় তাকালে দেখা মেলে একই পথ ধরে হেঁটে যাওয়া টুপি পরিহিত লোকজনের। আর ঠিক সেই সময়টাতেই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত স্বর্গীয় বাতাস বয়ে যায় চারিপাশে। তখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কারখানার আগুনের জ্বলন্ত শিখা আরো স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। প্রায়ই এ সময়টায় কিছু কুকুর রাস্তায় চিৎকার করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব করে, কেন করে কে জানে! এমন দিনগুলোতে বারবার মনে পড়ে পুরোনো বিআইডিসির কথা যখন ফ্যাক্টরি থেকে সেহেরীর সাইরেন না বাজা অব্দি জলের গ্লাস হাত থেকে নামতোই না। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ সীমা পিসিকেও মনে পড়ে যায়। ছোটবেলায় পিসিকে রাস্তায় দেখলেই ভয়ে দৌড়ে বাসায় পালাতাম। জানি না আমাদের সীমা পিসি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন!
এখন ভোর হবার অপেক্ষায় থাকা হয় শুধু ভোরবেলার বাতাসের ঘ্রাণ পাবার লোভে। তার আগে মন কেমনের রাতে খটমটে বই ভাল্লাগে না। রগরগে সিরিজে হাই ওঠে। মন চায় তারচেয়ে বরং কেউ এসে ধূপগন্ধী সন্ধ্যার গল্প বলুক। কেউ এসে বলুক ফেরিঘাটের খাবারে কেমন আদর্শ হিন্দু হোটেলের স্বাদ। বলুক ভালোবাসলেই কেন মরে যেতে ইচ্ছে হয়। সমস্ত ছেলেমানুষি ঠেলে দায়িত্ব নেবার মতো বড় হবার তাগিদ থাকায় ঘড়ির তালে তালে সময় মেলানোর পালা ফুরোতেই ভেঙে গেলো সময়ের আরাম, ছেড়ে এলাম আয়েস। তবু মনের রেডিওতে গান বেজেই চলে-
আরও দু'টো ছেলে-মেয়ের বয়েস বেড়ে যাবে
আরও দু'টো দিনের অবসান
আমার ছেলেমানুষিটা আঁকড়ে ধরে রেখে
গাইবো আমি ভালোবাসার গান!
Post a Comment