সুহাসিনী আলোকনন্দা- ১

 

সুহাসিনী আলোকনন্দা


আসরের আজান হচ্ছে। অন্য দিন হইলে এই সময় আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বড় মসজিদের আজান শুনা যাইতো। আজ সেটা হচ্ছে না। ক্রমাগত বৃষ্টি আরো বেড়েছে। ছাদের উপর পায়ের পাতা সমান পানি। টবের গাছ গুলা সিড়ির ঘরের টিনের নিচে বৃষ্টির তালে তালে নেচে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আশেপাশের সবগুলো বাসার জানালা এই মুহুর্তে বন্ধ। অনবরত ঝুমঝুম শব্দটা একনাগাড়ে বেজেই চলছে। সন্ধ্যার আগ অব্দি বৃষ্টি থামার সম্ভাবনা দুই পার্সেন্ট এর বেশি আর এক চিমটি ও হবেনা। সিড়ির ঘরের পিছনে দুইহাত খালি যায়গায় এলোমেলো চুলে উপুর হয়ে পড়ে আছে একটা মেয়ে। তরতাজা শরীর। মারা গেছে বেশিক্ষণ হয়নি। বিশ-একুশ বছর হবে। মেয়েটার হাতদুটো কি অদ্ভুত রকমের সুন্দর। একদম দুধে-আলতা রঙ।


রঞ্জুর চোখ খুলতেই এক ঝটকায় বসে পড়েছে। কারেন্ট নেই। পুরো শরীর ঘেমে একাকার। বড় বড় চুল গুলো মুখের সামনে জটলা পাকিয়ে এসে পড়েছে। ঘরের ভিতর কেমন ভ্যাপসা গন্ধ। বালিশের নিচে সিগারেট এর প্যাকেটে আর মাত্র একটাই সিগারেট বাকি। মাইগ্রেন এর ব্যাথা হচ্ছে। এই ব্যাথাটা এই মুহুর্তে মাথার ভিতর ঝড় তুলে দিয়েছে। সিগারেট এ টান দিতে দিতে স্বপ্নটা চোখে ভেসে উঠে রঞ্জুর মনে। আজকাল সব কিছুই খাপছাড়া। স্বপ্ন গুলোও ভিষণ অদ্ভুত। সব কিছুই তার বাস্তবের মতো এলোমেলো। তবে এই সমস্যা টা ইদানীং নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় রাতেই এখন এমন অদ্ভুত অর্থহীন স্বপ্ন দেখতে হয়। একটু আগে দেখা স্বপ্নটার শুধু এতোটুকুই মনে আসছে তার,

"কাক ভেজা খালি শরীরে বৃষ্টির পানি পড়ছে অনবরত। ছাদের জমে থাকা পানিতে পা ডুবে ছিলো। পিছনের কার্নিশের পাশেই তার সামনেই একটা মেয়ের লাশ পড়ে ছিলো৷ মেয়েটার হাত দুটো অসম্ভব সুন্দর।"

এর বাহিরে আগে-পরের কিছুই মনে পড়ছে না তার। 

রাত চারটায় এখন মাইগ্রেন হচ্ছে। চিৎকার দিতে মন চাইলেও এখন সেটা সম্ভব নয়। পাশেই খাটের উপর নুরু ভাই মরার মতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। দুনিয়াতে উনি সম্ভবত রাস্তার একটা নেড়িকুত্তাও সহ্য করতে পারেন কিন্তু রঞ্জুরে পারেন না। ছোট একটা ক্যান্টিন চালায় নুরু ভাই। বাপ মরার পর থেকে পড়াশোনা বাদ দিয়েছিলেন। ছোট এই ক্যান্টিন টা দিয়েই ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। গ্রামের বাড়িতে উনার মা একাই থাকে। ছয়মাস আগে বিয়ে করছিলো। কিন্তু বিয়ের ২৩ দিনের মাথায় বউ নাকি পালিয়ে গেছে অন্য কারো সাথে। তবে এ বিষয় নিয়ে উনি একদমি অস্থির না। উনি হলেন ঠান্ডা মস্তিষ্কের বদমেজাজী মানুষ। এই ধরনের মানুষ গুলো অযথা ও রাগ করে। খুবই সাধারণ বিষয় নিয়েও রাগারাগি করে ফেলেন। নুরু ভাইয়ের ঘুম ভাঙলে উঠেই গালি দিবেন। যদিও আগে কখনো গালি দিতেন না। তবে গত ছয়মাস থেকেই হঠাৎ করে উনি বাংলা-ইংরেজী যত বিদঘুটে গালি আছে তার নব্বই শতাংশ আমদানি করে ফেলেছেন। রঞ্জু সিগারেট এ টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো। ব্যাথাটা মনে হয় জান নিয়ে যাবে এমন অবস্থা। দাতে দাত চেপে সহ্যকরা ছাড়া কোনো উপায় নেই। স্বপ্নটা বারবার মনে পড়ছে, কিন্তু সব ঘোলাটে ঘোলাটে। পুরোপুরি মনে পড়ছে না। মেয়েটার হাত দুটো অসম্ভব সুন্দর ছিলো এতোটুকুই মাথায় চক্কর খাচ্ছে। বিরক্তিকর এই খাপছাড়া স্বপ্নটা মাথা থেকে বের করা দরকার। সিগারেট এ একের পর এক টান দিতে দিতে রঞ্জুর চোখে ভেসে উঠলো বছর খানেক আগের একটা রাত।

বৃষ্টির রাত ফোনের আলো জ্বলছে। সম্ভবত দেড়টা বাজে। পাশের রুমে সবাই ঘুমে। টেবিলের উপর কবিতার ডায়রিটা পড়ে আছে। টুকটাক কবিতা লিখতে ভীষণ ভালো লাগে রঞ্জুর। কিন্তু রঞ্জু মুখের ভিতর রুমাল কামড়ে ধরে শুয়ে আছে। টুং করে ম্যাসেজ এসেছে। মাইগ্রেন এর জন্য চোখে পানি জমে ঘোলা হয়ে আছে। ফোন টা হাতে নিয়েই ম্যাসেজ টা দেখলো সে। 


- আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না রঞ্জু। এইতো আমি। আপনার কাছেই আছি। রঞ্জু, আমি আপনাকে কত ভালোবাসি। একটু সহ্য করেন না প্লীজ। আমি আছিতো। আমার রঞ্জু কিচ্ছু হবেনা আপনার। আমার বুকে আসেন। আমি আপনারে জড়ায়ে ধরি। আমার বুকে শক্ত করে মাথা রেখে শুয়ে থাকুন।


রঞ্জু মুচকি হাসি দিয়ে ফোনটা আবার রেখে দিয়েছে।

ব্যাথাটা কমেছে বলে মনে হয় না। তবে মানসিক শান্তি অনুভব হচ্ছে। আবার ম্যাসেজ এসেছে। 


- শুনেন না, প্লিজ ঔষধ টা খেয়ে নেন। ঔষধ খেলে কাল সকালে পাঁচটা ছবি পাঠাবো। চোখে কাজল দিবো পাক্কা। প্লিজ খেয়ে নিন না।


রঞ্জু এবার চোখ মুখ মুচে সাথে সাথে উত্তর দিয়েছে। চোখের কোনায় আবার পানি জমায় ঘোলা ঘোলা লাগছে সব কিছু। আংগুল গুলো কাঁপছে। মাথার রগ গুলো সম্ভবত এক্ষুনি ছিড়ে যাবে।


- সুহাসী, এই মাইগ্রেন আমাকে কোনো ব্যাথাই দিতে পারেনা। তোমাকে ভেবে ভেবে আমার সমস্ত রাত পেরিয়ে যায়। তোমার খোলাচুলের কাঠগোলাপ গাঁথা ঘ্রান আমাকে প্রশান্তি এনে দেয়। তোমার চাহনি আমাকে ভুলিয়ে দেয় বিষাদগ্রস্ত বেদনা। তোমাকে নিয়ে লিখা সমস্ত কবিতা আমার হৃদয়ের প্রশান্তি। আমি ঔষধ খেয়ে নিয়েছি সুহাসী। তুমি চিন্তা করিও না।

আমার সুহাসিনী আলোকনন্দা, আমি ও তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি। তুমি আমার কাঠগোলাপ ফুল।


আজানের শব্দে রঞ্জুর হুশ ফিরেছে। ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। ইমাম সাহেব দুইবার বললেন "আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।"

রঞ্জু ফিসফিস করে "ঘুম হতে নামাজ উত্তম" বলে মুখের উপর জমা ঘাম মুচলো। মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। সিগারেট টা শেষ হয়ে গেছে। মাথাটা আপাতত কয়েকটন ভারি মনে হচ্ছে তার। কারেন্ট এসেছে কিছুক্ষণ আগে। ঘরের দেয়াল হাতরে হাতরে গোসলখানায় এসে ওযু আরম্ভ করেছে রঞ্জু। নামাজ পড়তে হবে। ইমাম সাহেব তো বলেই দিলেন "ঘুম হতে নামাজ উত্তম"। আর তার থেকেও বড় বিষয় হলো বহু গোপন ব্যাথা বলার আছে মালিকের কাছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই অযু শেষ করেছে রঞ্জু।

দরজার একপাশে প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়েই নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে সে। অনেক গুলো কথা বলার আছে রবকে। বলতেই হবে।





চলবে...

2 تعليقات

إرسال تعليق

أحدث أقدم